আইয়ুব বাচ্চু  ১৬ আগস্ট ১৯৬২ – ১৮ অক্টোবর ২০১৮ একজন বাংলাদেশী সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক ছিলেন। তিনি রক ব্যান্ড এল আর বি এর গায়ক ও গীটারবাদক হিসেবে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক বলা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চুর জানা অজানা যত কথা - biography of ayub bachchu

বাচ্চু  ভাই চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালে কলেজ জীবনে "আগলি বয়েজ" নামক ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিল। ১৯৭৭ সালে তিনি "ফিলিংস" (বর্তমানে "নগর বাউল" নামে পরিচিত) এ যোগদান করেন এবং ব্যান্ডটির সাথে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। একই বছরে তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ড সোলস- এর প্রধান গীটারবাদক হিসেবে যোগদান করেন। সোলসের সঙ্গে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, সুপার সোলস (১৯৮২), কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এবং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮) চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল। 

১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল তিনি তার নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করে, যা পরবর্তীকালে লাভ রান্স ব্লাইন্ড নামে বা সংক্ষেপে "এল আর বি" নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি তার মৃত্যু অবধি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর ধরে ব্যান্ডটির সঙ্গে ছিলেন। একজন একক শিল্পী হিসেবেও তিনি সফলতা পেয়েছিলেন। তার প্রথম একক অ্যালবাম (রক্ত গোলাপ), যা ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় অ্যালবাম - ময়না (১৯৮৮) দিয়ে, তিনি তার একক কর্মজীবনের সফলতা অর্জন করেন এবং পরে - কষ্ট (১৯৯৫) অ্যালবামটি প্রকাশ করেন, যা প্রচুর সফলতা অর্জন করে। ২০০৭ সালে তিনি দেশের প্রথম বাদ্যযন্ত্রগত অ্যালবাম সাউন্ড অফ সাইলেন্স প্রকাশ করেন।

বাচ্চু ভাই এল আর বি'র সাথে এবং একজন একক শিল্পী হিসেবে প্রচুর অ্যালবাম বিক্রয় করেছেন। বাচ্চু ভাই বাংলাদেশে একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদরক এবং অন্যতম প্রভাবশালী গীটারবাদক ছিলেন। দ্যা টপ টেনস তাকে বাংলাদেশের "শ্রেষ্ঠ ১০ জন গীটারবাদক" এর তালিকায় ২য় স্হানে দিয়েছেন (শুধুমাত্র ওয়ারফেজ এর ইব্রাহীম আহমেদ কমল এর পিছনে)। এল আর বি'র সাথে সে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে। ২০১৭ সালে সে টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জিতেছিলেন।

১৯৯০ সালের ৫ই এপ্রিল এই কিংবদন্তি ব্যান্ডটি যাত্রা শুরু করে। ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চু। টুটুল, জয় এবং স্বপন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সহ-সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পুরো নাম লাভ রান্‌স ব্লাইন্ড। শুরুতে ব্যান্ডটির নাম রাখা হয়েছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। আরো পরে এই নামটিও পরিবর্তন হয়ে এখন হয়েছে লাভ রান্‌স ব্লাইন্ড। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে এর যাত্রা শুরু, একটি ডব্‌ল্‌ এলবাম দিয়ে। 

এলআরবি-র প্রথম এই ডবলস্-টি বের হয়েছিল মাধবী এবং হকার নামে। এটি বাংলাদেশ এর ইতিহাসের প্রথম ডব্‌ল্‌ এলবাম। "চলো বদলে যাই" এলআরবি-র সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। ২০০৯ সালে তারা নকিয়া মিউজিক ফেস্টিভ্যালে গান করে। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি এলআরবি নগরবাউল ও মাইলস ব্যান্ডের সাথে নকিয়া কনসার্টে গান করে। এলআরবি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা সফর করেছে। 

ছয় বছর ধরে ফুসফুসে পানি জমার অসুস্থতায় ভোগার পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে হৃদরোগে তিনি নিজবাসায় ঢাকায় মারা যান। মৃত্যুর দুইদিন আগে সে রংপুরে তার শেষ অনুষ্ঠান করেছিল। তাকে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলি'তে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

বাচ্চু ভাইয়ের মাতৃপ্রেমের কথা সর্বজনবিদিত। তিনি সবসময় সবখানে তাঁর আইয়ুব বাচ্চু হয়ে উঠার পেছনে মায়ের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করতেন। কিন্তু বাচ্চু ভাইয়ের স্ট্রাগলের পেছনের পুরো গল্পটা জানেন খুব কম মানুষই৷ ক্লাস সেভেনে থাকতে বাচ্চু ভাইকে প্রথম গিটার কিনে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা এবং এটি ছিল ১৯৭৩ সালে তার ১১তম জন্মদিনের একটি উপহার। তার কিছুদিন পর বাচ্চু ভাইয়ের বাবা মায়ের সেপারেশন হয়ে গেলে বাচ্চু ভাইসহ তারা তিন ভাই মায়ের সাথে নানাবাড়িতে এসে উঠেন। সেখানেই বাচ্চু ভাইয়ের বেড়ে উঠা। 
বাচ্চু ভাইয়ের বাবা আরেক পক্ষের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে বাচ্চু ভাইদের খোঁজখবর রাখতেন না। সে সময় স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের নানারকম স্ট্রাগলের ভেতর দিয়ে যেতে হতো। পড়াশোনার চাইতে সেলসম্যান হিসেবে বেশি সময় দিতে হতো মামাবাড়ির পারিবারিক ব্যবসা রেয়াজুদ্দিন বাজারের তামাকুন্ডি লেনস্থ জুতার দোকানে। এর ভেতরেই সময় বের করে নিজের প্যাশন গিটারের পিছনে লেগে থেকে মায়ের বড় ছেলে রবিনের আইয়ুব বাচ্চু হয়ে উঠা। আইয়ুব বাচ্চুর প্রায় সব গানই কষ্টকে উপজীব্য করে। 

এই কষ্টের উৎস সবাই যেমনটা ধরে নেয় নারীঘটিত তেমনটি বোধহয় ছিলো না। বাচ্চু ভাই ১৯৮৬ সালে যখন তার একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ রেকর্ডের জন্যে ঢাকায় আসেন তখন সে তার এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল। তার বন্ধুর বাসায় একটি আয়নায় ফেরদৌস চন্দনার ছবি লাগানো ছিল৷ 

বাচ্চু ভাই সেই ছবি দেখেই তার বন্ধুকে বলেছিল যে, "সে চন্দনাকে বিয়ে করতে চায়"। তার সাথে যখন চন্দনার দেখা হয় তখন তারা একজন আরেকজন খুবই পছন্দ করে ফেলে৷ পরে যখন চন্দনার পরিবারে সবাই বাচ্চুর ব্যাপারে জেনে যায়, তখন তারা তাকে বাচ্চুর সাথে দেখা করতে দিত না। 
বাচ্চু ভাই বলেছিলেন যে, তার ব্যান্ড এলআরবি এর প্রথম অ্যালবাম এল আর বি - ১ এর একটি গান "ফেরারি মন", চন্দনাকে যখন তার পরিবার বাচ্চুর সাথে দেখা করতে দিচ্ছিলেন না, তখন বাচ্চুর কেমন মনে হচ্ছিলো তার কথাই বলে: 
"ফেরারি এই মনটা আমার, মানে না, কোনো বাধা৷ তোমাকে পাওয়ারই আশাই। ফিরে আসে বারে বার।" বাচ্চু ভাই তখন ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড এর একটি বাসায় থাকতো। তার কাছে মাত্র ৬০০ টাকা ছিল, যা দিয়ে সে কিছুই করতে পারছিলোনা৷ অ্যালবাম রেকর্ড করে সে আবার চট্টগ্রাম চলে আসে। কিন্তু তাও সে প্রায় সময়েই চন্দনা কে দেখতে ঢাকা আসতো৷ 
যখন সে ১৯৯০ এর শেষের দিকে সোলস ছেড়ে দেয়, তখন সে ঢাকায় আসে আর চন্দনা কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ চন্দনার পরিবার প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে যায়। সুতরাং নারীঘটিত কষ্ট নিয়ে পড়ে থাকার সময় তাঁর ছিলোনা। বাচ্চু ভাই নিজের পছন্দেই ফেরদৌস চন্দনা'কে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারিতে যার সাথে তার ১৯৮৬ সাল থেকে সম্পর্ক ছিল। যা সে সময় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া একটা চট্টগ্রামের ছেলের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিংই বলা যায়। তাদের দু'টি সন্তান আছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব।

২০০০ সালের দিকে 'প্রেম তুমি কি' এলবামে বাচ্চু ভাই তাঁর বাবাকে নিয়ে একটা গান করেন। অন্য সব গানের মত সেটি বাবার মহিমা বা প্রশস্তিসূচক গান ছিলোনা বরং এই গানে বাচ্চু ভাই বাবার প্রতি জমে থাকা তাঁর সকল অব্যক্ত কষ্ট আর ক্ষোভ ঢেলে দিয়েছেন। গানের লিরিকটা দেখলে বুঝবেন। 


প্রেম তুমি কি বলোত
কখনো আমার
কখনো আবার অপরিচিত কেউ
আহা প্রেম তুমি কি বলতো
এখনি আমার এখনি আবার
তুমি অন্য কারও
প্রেম তুমি কি বলতো
প্রথম দেখায় তোমার দুচোখ
দেখে ভুলে যায় আমি পৃথিবী
হঠাৎ দেখি তুমি নেই
পৃথিবীতো ঠিকি আছে, আছে স্বাভাবিক
তোমারি কারণে পৃথিবীতে ঘটে গেছে
কত অনা সৃষ্টি
তোমারি কারণে পৃথিবীতে হয়ে গেছে
কত অপরূপ সৃষ্টি
আহা প্রেম তুমি কি বলতো
কখনো আমার
কখনো আবার অপরিচিত কেউ
আহা প্রেম তুমি কি বলতো
ঠান্ডা হাওয়া হয়ে মানুষের মন জুড়ে
কখন যে তুমি এসে বসে থাকো
এই চোখ সেই চোখ
ঘুরে তুমি ঠিক ঠিক তোমারি প্রেম কে
ঠিকি বুকে টান
তোমারি কারণে পৃথিবীতে ঘটে গেছে

কত অনা…

বাচ্চু ভাই তারপরও ব্যক্তিজীবনে বাবার খোঁজখবর রেখেছেন। নিজের আপন তিন ভাইয়ের মত সৎ বোনদের প্রতিও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবা গুরুতর অসুস্থ্য হলে ঢাকায় নিয়ে দীর্ঘদিন নিজের কাছে রেখে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু যখন প্রয়োজন ছিলো তখন বাবাকে কাছে না পাবার কষ্ট মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন আমৃত্যু। অপ্রকাশিত কষ্টই নাকি সকল মহৎ সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। কোন গোপন কষ্ট, না পাবার বেদনা মানুষকে ক্রিয়েটিভিটি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়৷ বাচ্চু ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে কি? বাবার স্নেহবঞ্চিত হওয়াজনিত দুঃখবোধই কি ছিলো আইয়ুব বাচ্চুর সকল কষ্টভরা সৃষ্টির অনুপ্রেরণা?

আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নুরজাহান বেগম। তাদের পরিবার ছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তার মতে তাদের পরিবারে সবাই "অতি ধার্মিক ছিলেন এবং সঙ্গীত নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা কেউ গ্রহণ করেননি।" তারা তিন ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবীলি রোড এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন, যেখানে বাচ্চুর বেশিরভাগ কৈশর জীবন অতিবহিত হয়। 

তার কৈশর জীবনের শুরুর দিকে সে বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করেন, যেমন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রক ব্যান্ড লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্য জিমি হেনড্রিক্স এক্সপেরিয়েন্স ইত্যাদি। তন্মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গীটার বাজানো তাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল। তাকে গীটার শেখাতো জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ মানুষ যে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে থাকতো। 

১৯৭৬ এর দিকে সে তার এক বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইলেকট্রিক গীটার বাজাতো, যা ছিল একটি টিস্কো গীটার। পরে সে যখন গীটারটির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান, তার বন্ধু তাকে গীটারটি দিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে তাকে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। 

১৯৭৯ সালে সে ওই স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। 

চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল "গোল্ডেন বয়েজ"। পরে নাম বদলে করা হয় "আগলি বয়েজ"। সেই ব্যান্ডের গায়ক ছিল কুমার বিশ্বজিৎ এবং বাচ্চু ছিল গিটারিস্ট। সেই সময়ে তারা মূলত পটিয়ায় বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান গাইতো এবং শহরের বিভিন্ন ক্লাবে গান করতো। ১৯৮০ সালে বাচ্চু ও বিশ্বজিৎ যখন সোলসে যোগদান করে তখন ব্যান্ডটি ভেঙে যায়।

জেমস ১৯৭৭ সালে তার নিজের ব্যান্ডে কাজ করার পাশাপাশি সে ফিলিংস নামের একটি রক ব্যান্ডে যোগ দেন গিটার বাদক হিসেবে, যেখানে তিনি কাজ করেছিলেন জেমস এর সঙ্গে। জেমস বলেছিল, সে বাচ্চুকে একটি চায়ের দোকানে গিটার বাজাতে দেখেছিল এবং বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখেই সে তাকে ফিলিংসে যোগ করতে বলেন। বাচ্চু তার কথায় রাজি হয়ে যান এবং পরবর্তী তিন বছর, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওই ব্যান্ডে কাজ করেন। 

১৯৮০ সালে সোলসের গিটার বাদক সাজেদ উল আলম উচ্চশিক্ষার জন্যে আমেরিকায় চলে যায়। একরাতে যখন ফিলিংস চট্টগ্রামের একটি ক্লাবে অনুষ্ঠান করছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিল সোলস ব্যান্ডের নকীব খান। বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং সোলসের গায়ক তপন চৌধুরী কে বাচ্চুর ব্যপারে বলেন। পরদিন রাতে তারা ফিলিংস এর অনুষ্ঠান দেখতে আসে এবং বাচ্চুকে সোলসে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বলেন। বাচ্চু একই বছরের মাঝামাঝি সময়ে "আগলি বয়েজ" এর গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথে যোগ দেন। 

পরবর্তী দশ বছর সে সোলস এর মূল গিটার বাদক, গীতিকার এবং গায়ক (অনিয়মিত) হিসেবে কাজ করে। সে সোলসের সাথে চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল: সুপার সোলস (১৯৮২) যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম গানের অ্যালবাম, কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এই অ্যালবামটিতেই বাচ্চুর সোলসের হয়ে গাওয়া প্রথম গান "হারানো বিকেলের গল্প" প্রকাশ পায়। সোলসের সাথে তার শেষ অ্যালবামটি ছিল ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, যা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে বাচ্চু ব্যান্ডটি ছেড়ে নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করেন, যা পরবর্তী সময়ে লাভ রানস ব্লাইন্ড বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সোলস ত্যাগ করার পরেও বাচ্চু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তপন চৌধুরী, নকিব খান এবং কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথে অনুষ্ঠান করেছে। ২০১২ সালে বাচ্চু ভাই "দ্য ডেইলি স্টার" কে বলেছিলেন:

আমি সোলস ত্যাগ করেছি কেননা আমার সাথে তাদের পার্থক্য ছিল। তারা একধরনের গান করতে পছন্দ করতো আর আমি আরেকধরনের গান করতে পছন্দ করতাম। আমার পছন্দ ছিল উচু আওয়াজের, বেশি রকিং গিটারের গান। আর বাকিদের পছন্দ ছিল শান্ত, সুমধুর গান। আপনি দিনের পর দিন শুধু আপোস করতে পারবেন না। আমাদের মাঝে তেমন একটা বড় ধরনের ঝগড়া হয় নি কোনোদিন। আমার মনে হয়েছিল যে, আমি নিজের মতো গান করলে ভালোই হবে।

১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে বাচ্চু সোলস থেকে বের হয়ে আসার পর ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকায় আসেন, তিনি '"ইয়েলো রিভার ব্যান্ড"' নামের একটি ব্যান্ড গঠন করেন ৫ এপ্রিল ১৯৯১ সালে, এস আই টুটুল (কীবোর্ডস), সাইদুল হাসান স্বপন (বেজ গিটার) এবং হাবিব আনোয়ার জয় (ড্রামস)।

১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তারা ভারতে অনুষ্ঠান করতে গেলে তাদের ভুলে "লিটল রিভার ব্যান্ড" নামে পরিচিত করানে হয়। নামটি বাচ্চু পছন্দ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তার ব্যান্ড নামকরণ করেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে, এলআরবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রথম কনসার্টটি করে।

কনসার্টটি বামবা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যা স্বৈরাচারী নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর পতনের উদযাপন করেছিল। ১৯৯২ সালের জানুয়ারী মাসে, তারা বাংলাদেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম: এলআরবি ১ এবং এলআরবি ২ প্রকাশ করেছিল। ব্যান্ডটির তৃতীয় স্টুডিও অ্যালবাম সুখ, জুনে মুক্তি পায় এবং এটি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রক অ্যালবামগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। 
এতে "চলো বদলে যাই" গানটি ছিল যা বাচ্চুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসাবে বিবেচিত। তারা ১৯৯০ এর দশকে আরও কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ করে এবং শীঘ্রই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রক ব্যান্ডের মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালে, তারা ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠান করেছিল, যা বাংলাদেশের বাইরে তাদের প্রথম কনসার্ট ছিল। এলআরবি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন অনুষ্ঠান করা একমাত্র বাংলাদেশী ব্যান্ড।

বাচ্চুর মৃত্যুর পর, এলআরবির অন্যান্য সদস্যদের বালাম জাহাঙ্গীর কে তাদের নতুন গায়ক হিসাবে ঘোষণা করেন। বাচুর স্ত্রী এবং মেয়ে এলআরবির নামে নতুন গায়কের সাথে এবং ব্যান্ড সদস্যদের সন্তুষ্ট ছিল না। তারা ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করতে বলে সদস্যদের। ব্যান্ড কয়েক দিনের জন্য বন্ধ করা হয় এবং পুরোনো সদস্যরা বালামের সাথে "বালাম এবং দ্য লেগ্যাসি" নামক একটি নতুন ব্যান্ড গঠন করে। 

বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস বলেছেন যে: "বাচ্চু এলআরবি এর একমাত্র মালিক, শুধুমাত্র তার উত্তরাধিকারী একই নামে ব্যান্ড চালাতে পারে।" ১৫ এপ্রিল ২০১৯ সালে, বাচ্চুর ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব তার ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করেছেন যে তিনি ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্যদের সাথে এল আর বি নাম ব্যবহারে বাধা দেবে না এবং পরে বাচ্চুর স্ত্রী ও কন্যাও একমত হয়েছিলেন।

সোলস এ কাজ করার সময়কাল থেকেই বাচ্চু ভাই একজন একক শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন এবং দুটি অ্যালবাম বের করেছিলেন: রক্ত গোলাপ (১৯৮৬) এবং ময়না (১৯৮৮)। উভয় অ্যালবামেই মূলত পপ রক গান ছিল৷ ওই অ্যালবাম গুলোর কিছু গানে বাংলা আধুনিক গানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এবং তবলার মতো যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়৷ 

রক্ত গোলাপ অ্যালবামটিতে মূলত পপ, বাংলা আধুনিক গান এবং একটি মাত্র রক ঘরানার গান রয়েছে "অনামিকা"। ময়না অ্যালবামটিতে পপ রক, হার্ড রক এবং বাংলা আধুনিক ঘরানার গান রয়েছে। ওই অ্যালবাম দিয়েই বাচ্চু জনপ্রিয়তা লাভ করে। পুরো দেশে অ্যালবামটির ৬০,০০০ হাজার কপি বিক্রিত হয়েছিল। 

রক্ত গোলাপ, ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বের হয় এবং ওই অ্যালবামটিতে বাচ্চুর প্রথম হার্ড রক গান ছিল, "অনামিকা"। জাহেদ ইলেকট্রনিক্স অ্যালবামটি বের করেছিল। ফিলিংস ব্যান্ডের ড্রামার এহসান এলাহি ফান্টি অ্যালবামটিতে ড্রাম বাজিয়েছিল, মাইলস ব্যান্ডের মানাম আহমেদ কীবোর্ডস বাজিয়েছিল। বাচ্চু ইলেক্ট্রিক গীটার ও বেজ গীটার উভয়ই বাজিয়েছিল৷ ময়না অ্যালবামটিতে একই সদস্যেরা ছিলেন এবং আরও ছিলেন খায়েম পিয়ারু (বেজ গীটার), ইমন ও মিন্টু (কীবোর্ডস)।

১৯৯০ সালের শেষের দিকে সোলস ব্যান্ডটি ত্যাগ করেন। ৫ই এপ্রিল বাচ্চু ভাই তার ব্যান্ড "এল আর বি" গঠন করেন। ওই বছর থেকেই নিজের ব্যান্ডের সাথে ব্যাস্ত থাকায় বাচ্চু ভাই নিজের কোনো অ্যালবাম বের করেনি। ১৯৯৫ সালে এল আর বি এর ঘুমন্ত শহরে অ্যালবামের পর বাচ্চু ভাই নিজের অ্যালবাম কষ্ট রেকর্ড করার জন্যে অডিও আর্ট স্টুডিও তে যান, যেখানে তার ব্যান্ডের অ্যালবামটি রেকর্ড করা হয়েছিল। 

১৯৯৫ সালের অক্টোবরে অ্যালবামটি সাউন্ডটেক ইলেকট্রনিকস থেকে বের হয়। অ্যালবামটি বের হওয়া মাত্রই প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেকের মতে এটি বাচ্চুর সবচেয়ে সেরা অ্যালবাম। "কষ্ট পেতে ভালোবাসি", "কষ্ট কাকে বলে" এবং "জেগে আছি একা" এর মতো জনপ্রিয় কিছু গান আছে অ্যালবামটিতে। আজম বাবু ছিলেন অ্যালবামের প্রযোজক আর বাচ্চু ছিলেন সহ-প্রযোজক। বাচ্চুর ব্যান্ড এল আর বি এর সদস্য এস আই টুটুল এই অ্যালবামে কীবোর্ডস বাজিয়েছিল এবং ফিলিংস ব্যান্ডের এহসান এলাহি ফান্টি অ্যালবামটিতে ড্রামস বাজিয়েছিল। এক বছরের ভেতরেই অ্যালবামটির ৩ লক্ষ কপি বিক্রিত হয়েছিল।

যদিও বাচ্চু ভাই সোলস ছেড়ে দিয়েছিল, হার্ড রক গান করার জন্যে, একজন একক শিল্পী হিসেবে সে মূলত পপ রক ও সফট রক ঘরানার গান করতেন। সংগীত জীবনের শুরু থেকেই বাচ্চু ভাই ব্লুজ, জ্যাজ ও ফাংক ঘরানার গানের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন৷ সে তার ব্যান্ড এল আর বির অনেক গানে এইসব ঘরানার গান করেছেন, কিন্তু সে তার একক সংগীত জীবনেও তার ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। 
১৯৯৮ সালের শুরুর দিকে এবি কিচেন নামের একটি স্টুডিও গঠন করেন ঢাকার মগবাজারে, যা পরবর্তীকালে একটি রেকর্ড লেবেলে পরিণত হয়। বাচ্চু ভাই একজন একক শিল্পী হিসেবে একটি ডবল অ্যালবাম বের করতে চেয়েছিল। তাই সে তার চতুর্থ ও পঞ্চম অ্যালবামটি একটি ডবল অ্যালবাম হিসেবে বের করার চিন্তা করেন৷ 
১৯৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে অ্যালবাম দুটির রেকর্ড শুরু হয় তার নিজের স্টুডিওতে। ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে সময় ও একা অ্যালবাম দুটি সাউন্ডটেক ইলেকট্রনিকস থেকে বের হয়৷ তার পূর্বের অ্যালবাম গুলোর তুলনায় এই দুটি অ্যালবাম তেমন একটি কপি বিক্রি ও করেনি আর মানুষের তেমন পছন্দ ও হয়নি৷ বাচ্চু ভাই এই অ্যালবাম দুটি সম্পর্কে বলেছিলেন যে:

ওই দুটি অ্যালবাম মানুষ একেবারেই পছন্দ করেননি৷ আমার প্রতিদিনের দর্শকেরা ভেবেছিল যে, অ্যালবাম গুলো বেশি বাজে হয়েছে। তারা তেমন কিছু চায়নি। এরপর আমি আমার একক সংগীত জীবনে তেমন একটা অন্য ঘরানার সাথে রক গান করিনি। কেউ যদি পছন্দ না করে অ্যালবাম বের করে লাভ কি?

আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রূপালী গিটার আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয় রূপালী গিটার। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন।

ফেরারী এই মনটা আমার গানের লিরিক্স :

ফেরারী এই মনটা আমার
মানে না কোনো বাধা
তোমাকে পাওয়ারই আশায়
ফিরে আসে বারেবার।

কখনো ভাবিনি আমি,
ব্যাথা দিয়ে তুমি চলে যাবে
কি জানি কি ভুল ছিল আমার,
আমাকে কেনো গেলে কাঁদিয়ে
তাই আমি ফিরে আসি বারেবার

ফেরারি এই মনটা আমার
মানে না কোনো বাধা
তোমাকে পাওয়ারই আশায়
ফিরে আসে বারেবার।

যে পথে হারিয়েছি তোমায়,
সেই পথে খুঁজে আমি যাবো
অভিমান করে থেকো না,
অপবাদ দিয়ে যেও না
তাই আমি ফিরে আসি বারেবার।

ফেরারি এই মনটা আমার
মানে না কোনো বাধা
তোমাকে পাওয়ারই আশায়
ফিরে আসে বারেবার।

Ferari ei mon ta amar
mane na kono badha
Tomake pawari ashay
fire ashe bare bar

Kokhono bhabini ami..
betha diye tumi chole jabe
Ki jani ki bhul chilo amar
amake keno gele kandiye
Tai ami - fire ashi bare bar
Ferari ei mon ta amar
mane na.. kono badha
Tomake pawari ashay
phire ashe bare bar

Je pothe hariyechi tomay..
sei poth khuhje ami jabo
Abhiman kore theko na..
opobad diye jeo na
Tai ami - phire ashi bare bar

এক নজরে বাচ্চু ভাইর একক অ্যালবাম

রক্ত গোলাপ (১৯৮৬)
ময়না (১৯৮৮)
কষ্ট (১৯৯৫)
সময় (১৯৯৮)
একা (১৯৯৯)
প্রেম তুমি কি! (২০০২)
দুটি মন (২০০২)
কাফেলা (২০০২)
প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩)
পথের গান (২০০৪)
ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬)
জীবন (২০০৬)
সাউন্ড অব সাইলেন্স (২০০৭)
রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮)
বলিনি কখনো (২০০৯)
জীবনের গল্প (২০১৫)
সোলস

সুপার সোলস (১৯৮২)
কলেজের করিডোরে (১৯৮৫)
মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭)
ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮)
নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী

লুটতরাজ (১৯৯৬)
সাগরিকা (১৯৯৮)
লাল বাদশা (১৯৯৯)
আম্মাজান (১৯৯৯)
গুন্ডা নাম্বার ওয়ান (২০০০)
ব্যাচেলর (২০০৪)
রং নাম্বার (২০০৪)
চাঁদের মত বউ (২০০৯)
৮:০৮-এর বনগাঁ লোকাল (২০১২)
চোরাবালি (২০১২)
টেলিভিশন (২০১৩)
এক কাপ চা (২০১৪)

সবাই দুয়া করবেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের প্রিয় বাচ্চু ভাইকে মাফ করে দেন, জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব হয়।